শতবর্ষী রাজেন্দ্র কলেজ: ঐতিহ্যের ধারা
অবিভক্ত বাংলার বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত বৃহত্তর ফরিদপুর ও সন্নিহিত অঞ্চলে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে কোন বিদ্যাপীঠ ছিল না। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষা লাভের মোটামুটি ভাল ব্যবস্থা থাকলেও উচ্চশিক্ষা মূলত কোলকাতা কেন্দ্রিক। ফলে মাধ্যমিক (ম্যাট্রিক) পাশের পর অধিকাংশের পক্ষেই, ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও, আর্থিক অসচ্ছলতাসহ নানা কারণে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হতো না। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই ফরিদপুর শহরে একটা কলেজ স্থাপনের চিন্তাভবনা শুরু করেন তখনকার শিক্ষিত মহল। এ নিয়ে তারা জেলা কালেক্টরের বিভিন্ন সময়ে আলাপ আলোচনাও করেন। কিন্তু, তাতে কোন অগ্রগতি হয়নি। এমতাবস্থায়, ফরিদপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি, কংগ্রেস নেতা খ্যাতনামা আইনজীবী ও সমাজসেবক শ্রী অম্বিকাচরণ মজুমদার কলেজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে এগিয়ে আসেন বস্তুত তাঁরই সক্রিয় উদ্যোগে, অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও সাহসী নেতৃত্বে ১৯১৮ সালে রাজেন্দ্র কলেজের যাত্রা শুরু। তবে, এরও আগে ১৯১২ সালে গভর্নর লর্ড কারমাইকেল ফরিদপুরে এলে তাঁর কাছে ফরিদপুর শহরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়। অথচ, তিনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হন। অতঃপর ফরিদপুর কলেজ প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জেলার বিখ্যাত আইনজীবী এবং প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদার ।
১৯১৫ সালের ১৫ নভেম্বর উদ্যমী পুরুষ অম্বিকাচরণ মজুমদার ফরিদপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা করেন। এ সভায় ফরিদপুর শহরে একটি দ্বিতীয় গ্রেডের কলেজ স্থাপনের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য তাঁর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি মাস দেড়েকের মধ্যেই ফরিদপুর শহরের পূর্ব পার্শ্বে (বর্তমান শহর ক্যাম্পাস) খেলার মাঠ ও মাঠে অবস্থিত মেলা ভবনের আংশিক পরিবর্তন করে কলেজ ভবনে রূপান্তর করার পরিকল্পনা পেশ করেন। কলেজপ্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য ৮০ হাজার টাকার প্রাথমিক তহবিল গঠনেরও সুপারিশ করেন উক্ত কমিটি ।
১৯১৬ সালের ৯ জানুয়ারি অম্বিকাচরণ মজুমদারকে সভাপতি করে কলেজ কমিটি গঠিত হয়। কমিটি শহরের ব্যবসায়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিকট থেকে ৪০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন ।
আরও টাকা কীভাবে সংগ্রহ করা যায় সেটাই ছিল অম্বিকাচরণের সারাক্ষণের চিন্তা। এ অবস্থায় একদিন তাঁর মক্কেল ফরিদপুর জেলার বাইশরশির জমিদার রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর নিকট আর্থিক সাহায্যের বিষয়টি উত্থাপন করেন।
রমেশ চন্দ্র রায় চৌধুরী কলেজের নাম তাঁর স্বর্গীয় পিতা রাজেন্দ্র চন্দ্র রায় চৌধুরীর নামে করার শর্তে ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। ১৩ আগস্টের সভায় কলেজ কমিটি উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কলেজের নাম ‘রাজেন্দ্র’ কলেজ রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অতঃপর কলেজ কমিটির সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার খেলার মাঠ ও মেলা ভবন মাঠের জমি থেকে ৫.২০ একর খাস জমি বরাদ্দের জন্যে সরকারের কাছে এবং কলেজ অধিভুক্তির জন্যে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন জানান।
১৯১৬ সালের ৩০ আগস্ট জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) ফরিদপুর সফরে এলে অম্বিকাচরণ মজুমদার তার সঙ্গে সাক্ষাত করে কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর সহযোগিতা কামনা করেন। জনশিক্ষা পরিচালক কলেজ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। উল্লেখ্য, সে সময় কোথাও কোন কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রথমেই ছাত্রাবাস তৈরি করতে হতো। তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন ও অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করা যেত না। ১৯১৭ সালের ৮ মার্চ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের নির্দেশে দুজন পরিদর্শক ফরিদপুর সফরে আসেন। পরিদর্শন শেষে তাঁরা তাঁদের প্রতিবেদনে কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করেন। এ সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কমিটি তাদের পরিকল্পনা ঢেলে সাজিয়ে কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ চূড়ান্ত করার কজে হাত দেন। এমতাবস্থায়, বাংলা সরকারের সচিব প্রেরিত পত্রে মেলার মাঠের খাস জমি মঞ্জুর করতে সরকারের অস্বীকার জানানো হয়।
কিন্তু, হতোদ্যম হননি অম্বিকাচরণ মজুমদার। বরং এ সময়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন আইসিএস অফিসার মি. জি.জে. ডানলপ। তিনি এক পত্রে সরকারের কাছে উক্ত খাস জমি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বরাদ্দের আবেদন করেন। ডানলপের পত্র বলে বলীয়ান কলেজ কমিটি ১৯১৭ সালের ৩০ জুলাই জেলা কালেক্টরের মাধ্যমে জমির জন্য পুনরায় আবেদন করেন । এর কয়েক দিন পরে বাংলার গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে ফরিদপুর সফর এলে অম্বিকাচরণ মজুমদার তঁকে কলেজ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরে মেলার মাঠের খাসজমি বরাদ্দ দেওয়ার আবেদন জানান। রোনাল্ডসে জানান যে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা অনুমোদন করলে সরকার জমি প্রদানের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করবে। এ আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে কলেজ কমিটি পুরোদমে তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। অম্বিকাচরণ মুজুমদারকে বাংলা সরকারের সচিব ডনমেলি এক তার বার্তায় জানান যে, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদি কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা, তার আর্থিক ভিত্তি, ছাত্রদের আবাসিক ব্যবস্থা, শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি অনুমোদন করে তাহলে সরকার কলেজকে জমি প্রদানে প্রস্তুত আছে। তারপর কলেজ কমিটি বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর নতুন করে আবেদন করেন।
ইতোমধ্যে কলেজ গভার্নিং বডি পুনর্গঠিত হয়। এ সময়েই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ইংরেজি সাহিত্যের অভিজ্ঞ অধ্যাপক কামাখ্যা নাথ মিত্রকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট এর প্রস্তাবে জমি প্রদান সংক্রান্ত সরকারি আদেশ পেশ করতে বলে। কিন্তু, তখনও পর্যন্ত জমি বরাদ্দের আদেশ পাওয়া যায়নি। এদিকে ১৯১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পৌর চেয়ারম্যান মথুরা নাথ মিত্র তাঁর উপর অর্পিত ক্ষমতা বলে দলিল সম্পাদন করে মেলা ভবন কলেজ কমিটির কাছে এক হাজার টাকায় বিক্রয় করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট তা পেশ করেন। এ সময় বাংলা সরকারের পক্ষ থেকে কলেজকে বার্ষিক নামমাত্র এক টাকা খাজনার বিনিময়ে মেলার মাঠে ৫.২০ একর জমি মঞ্জুর করা হয়। কালবিলম্ব না করে অম্বিকাচরণ মজুমদার উপাচার্যের সঙ্গে সাক্ষাত করে মঞ্জুরি পত্রটি প্রদান করেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটের সুপারিশসহ কলেজ কমিটির আবেদন পত্র ভারত সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করেন। প্রথমে কলেজটিকে মেলার মাঠের ৫.২০ একর জমি প্রদানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তা মঞ্জুর করা হয়।
কিন্তু, পরে দেখা গেল মেলা ভবনের পূর্ব এবং উত্তরে এক ফালি জমি না পেলে কলেজ ভবনের জন্য সুবিধাজনক স্থান সংকুলান হয় না। বিষয়টি অনুধাবন করে মেলা ভবনসহ ৫.৫৫ একর জমির প্রদানের নকশা প্রণয়ন করে সরকারের নিকট পেশ করা হয়। তখন কলেজ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত ছিল ছাত্র হোস্টেল প্রতিষ্ঠা। অম্বিকাচরণ মুজুমদারের অনুরোধ মহারাজ মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দী ৩০,০০০/-(ত্রিশ হাজার) টাকা হোস্টেল প্রতিষ্ঠার জন্য দান করে আর একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এদিকে, কলেজ কমিটি ছাত্রাবাস নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন এবং ১৯১৭ সালের মার্চের মধ্যে তা সমাপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেন। এই সময় কলেজ কমিটি কলেজ ভবন নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত ছাত্রাবাসে ক্লাস করার অনুমতি চান। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রস্তাবে রাজি হলেও তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের অনুমোদন পাওয়া যায়নি। ইতোমধ্যে বাংলা সরকার ১৯১৮ সালের ১২ মার্চ কলেজ কমিটির প্রস্তাব গ্রহণ করে ৫.৫৫ একর জমি মঞ্জুর করে এবং কালেক্টরের মাধ্যমে তা কমিটির নিকট হস্তান্তর করেন।
১৯১৮ সালের ৮ এপ্রিল ফরিদপুর জেলার কালেক্টর মি. ডানলপ কলেজ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অবশেষে দেনদরবারের মাধ্যমে ১৯১৮ সালের ১৩ মে কলেজ বার্ষিক মাত্র এক টাকা খাজনার বিনিময়ে ৫.৫৫ একর জমি মঞ্জুর করেন।
এভাবে সকল বাধা বিপত্তি অপসারিত হওয়ায়, পূর্ণোদ্যমে শুরু হয় কলেজের কাজ। ইতোমধ্যে ১৯১৮ সালে ১জুন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কামাখ্যা নাথ মিত্র যোগদান করেন। এছাড়া অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন শিরীষ চন্দ্র সেন (দর্শন), দেবেন্দ্র নাথ দত্ত (গণিত), দীনেশ চন্দ্র মজুমদার (সংস্কৃত), শিরীষ কুমার আচার্য (ইতিহাস)। এর কিছু পরে নিয়োগ পান ফজলুল হক (আরবি ও ফারসি)। ১৯১৮ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে কলেজের কাজ শুরু হয় এবং ১০ জুলাই মাত্র ২৯ জন ছাত্র নিয়ে প্রথম ক্লাস শুরু হয়। কলা বিভাগের ক্লাস দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও ১৯২১ সালে আই.এস.সি এবং ডিগ্রি (পাস) কোর্স চালু হয়। ১৯২৩ সালের গভার্নিং বডির সহযোগিতায় এবং অধ্যক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইংরেজি, দর্শন, গণিত সহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে অনার্স চালু করা হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মফস্বলের কলেজে অনার্স চালু রাখতে অসম্মতি জানালে ১৯৪৯ সালে তা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে বিএসসি প্রথম ব্যাচ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এ সময় পর্যন্ত কলেজের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষার মান, ফলাফল ও অন্যান্য কর্মকাÐ বিবেচনা করে রাজেন্দ্র কলেজকে এ গ্রেডের কলেজে উন্নতি করা হয়। এ সময় ফরিদপুরের অন্যতম জমিদার ইউনুস আলী চৌধুরি (মোহন মিয়া) এবং তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম.এ. গওহর বিজ্ঞান শিক্ষায় উন্নয়নে ২৫ হাজার টাকা দান করেন। এ অর্থ দিয়ে একটি বিজ্ঞান ভবন নির্মাণ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কেনা হয়। ১৯৫৮ সালে নতুন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম.এ. সিদ্দিকের প্রচেষ্টায় শহর ক্যাম্পাসে মূল ভবনের দোতালা নির্মিত হয়। এ ভবন এক সময় অধ্যক্ষের কক্ষ, ছাত্রী মিলনায়তন ও লাইব্রেরি ছিল। শুধু পড়া শোনা নয়, শরীরচর্চার জন্য ১৯৫৭ সালে একটি জিমনেসিয়াম নির্মিত হয়। এক সময় রাজেন্দ্র কলেজ বলতে শহর ক্যাম্পাসকেই বোঝাতো। এখান থেকে পরিচালিত হত কলেজের প্রশাসনিক, অ্যাকাডেমিক ও অন্যান্য কার্যক্রম।
বর্তমানে এ কলেজের শহর ক্যাম্পাস ও বায়তুল আমান ক্যাম্পাস নামে দুটি ক্যাম্পাস আছে। বায়তুল আমান ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠারও রয়েছে এক ইতিহাস।
ছয়-এর দশকের গোড়ার দিকে দেশ জুড়ে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ছাত্র-ছাত্রী বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরাতন ভবন স¤প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেজন্য প্রয়োজন অতিরিক্ত জমি । ইতোমধ্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কলেজের উন্নয়নের জন্য ২৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করে। এমতাবস্থায়, কলেজ গভার্নিং বডি শিক্ষা বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী শহরের বাইরে জমি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এ প্রেক্ষাপটে কলেজের মূলভবন থেকে ৩ কিলোমিটার দুরে চৌধুরি পরিবার প্রতিষ্ঠিত বায়তুল আমান কমপ্লেক্স থেকে ১৫ একর জমি ক্রয় করা হয়। এ জমির উপর ষাটের দশকের শুরুতেই কলেজের বায়তুল আমান ক্যাম্পাসের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালে এ ভবন গুলোর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এ বছরেই কলেজকে প্রাদেশিকীকরণ করা হয় এবং সরকারিভাবে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করা হয় বিশিষ্ট গবেষক ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর শিব প্রসন্ন লাহিড়ী (পরবর্তীতে পিএসসি সদস্য)। ইতোমধ্যে ছাত্র আন্দোলন, গণ-আন্দোলনের তরঙ্গে সারা দেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে ঘনিয়ে অসে বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালে এখানে পাক হানাদার ক্যাম্প স্থাপন করে, পরে তাদের পরাভূত করে স্থাপিত হয় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প।
মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে বায়তুল আমান ক্যাম্পেসে ডিগ্রি শাখা স্থানান্তর নিয়ে চলে দীর্ঘ টানাপড়েন। এভাবে ভবনগুলো অব্যবহৃত থাকার ফলে প্রায় ধ্বংসোম্মুখে হয়ে পড়ে। ১৯৭৮-৭৯ সাল থেকে নতুন ভবন নির্মাণ ও পুরাতন ভবনগুলোর সংস্কার কাজ শুরু হয়। ১৯৮৩ সাল নাগাদ ভবনগলো পুরোপুরি ক্লাসের উপযোগী করে তোলা হয়। অতঃপর ১৯৮৪ সালে ৬ টি অনার্স বিষয় ও ডিগ্রি (পাস) কোর্সের ক্লাসসমুহ বায়তুল আমান ক্যাম্পাসে স্থান্তর করা হয়। ১৯৯৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর পাঠ দান বন্ধ করে দেওয়া হলে ডিগ্রি (পাস) কোর্সের ক্লাসসমূহ শহর ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করা হয়।
১৯৭১-৭২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ৬ টি বিষয়ে অনার্স চালু হলেও সময়ের ধারাবাহিকতায় বর্তমান ১৯ টি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। এছাড়া দুটি বিষয়ে মাস্টার্স (প্রাইভেট) পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। ২০০৮ সাল থেকে আবার উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠদান কর্যক্রম শুরু হয়েছে। বর্তমানে রাজেন্দ্র কলেজের প্রশাসনিক ভবন শহর ক্যাম্পাসে অবস্থিত। এ ক্যাম্পাসেই উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রি (পাস) কোর্সের সকল কার্যক্রম এবং বিজ্ঞান অনুষদের কয়েকটি বিষয়ের ব্যবহারিক ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়।
১৯১৮ সালে স্বল্পসংখ্যক ছাত্র ও শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী প্রায় ৩০ হাজার এবং শিক্ষকের পদ সংখ্যা ১৭৯ টি। এভাবেই এগিয়ে চলছে দেশের অন্যতম বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী এ কলেজটি ।
শুধু শিক্ষা-দীক্ষা নয়, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন সমাজ সেবক কর্মকান্ডেও কলেজের ভূমিকা অত্যন্ত উজ্জ্বল। মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক কর্যক্রম, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা পরীক্ষার ফলাফল ও সার্বিক শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বিচারে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করেছে। নিঃসন্দেহে এ কলেজ শিক্ষাঙ্গনে বাংলাদেশের রোল মডেল।
দীর্ঘ ১০০ বছর আগে শিক্ষানুরাগী, মানবদরদি অম্বিকাচরণ মজুমদারের উদ্যোগ, প্রচেষ্টাও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে আলোকশিখা প্রজ্জ্বলিত করে যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজেন্দ্র কলেজের, আজ তা শত ধারায় বিচ্ছুরিত। সময়ের স্রোতে এ ধারা আরো গতিশীল ও জোরালো হবে, সমুন্নত ও সমুজ্জ্বল হবে এর ঐতিহ্যের অভিজ্ঞান।